১০:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুবাইয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের অঢেল সম্পদের সন্ধান

বাংলাদেশি ধনীদের কাছে দুবাই ভীষণ প্রিয়। অনেকে এটিকে সেকেন্ড হোম হিসেবে আপন করে নিয়েছেন। দুবাইয়ের দ্রুত সম্প্রসারিত আবাসন খাত বাংলাদেশিদের জন্য সম্পদ গচ্ছিত রাখার আকর্ষণীয় জায়গা। এর বড় কারণ হলো—সুউচ্চ ভবন ও পর্যটনের জন্য খ্যাত দুবাইয়ে নগদ অর্থ দিয়ে সম্পত্তি কেনা যায়। এমনকি শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোও নগদ অর্থে সম্পত্তি বিক্রি করে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বারবারই দুবাইকে হুন্ডি লেনদেনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। বিশাল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক ও বাংলাদেশিদের সেখানে অবস্থান করা এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া, দুবাইয়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার ডলার বা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি অর্থ দেশটির সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করলে ‘গোল্ডেন ভিসা’ পাওয়া যায়।

দুবাইয়ের ভূমি বিভাগের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রিয়েল এস্টেট খাতে ২০ লাখ আরব আমিরাত দিরহাম বা তার বেশি দামের সম্পত্তি ক্রয়ে বিনিয়োগকারীদের ১০ বছরের নবায়নযোগ্য রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদন করার সুযোগ দেয় এই সেবা (গোল্ডেন ভিসা)। স্বামী বা স্ত্রী, সন্তান ও পিতামাতাকেও এই ভিসায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যদি সম্পত্তিটি বন্ধক থাকে, তাহলে ২০ লাখ দিরহাম পরিশোধের প্রমাণ হিসেবে ব্যাংকের একটি চিঠি জমা দিতে হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্যাক্স অবজারভেটরির ২০২১ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন অফশোর সম্পত্তির দাম ২৬ কোটি ডলার বা প্রায় ৩ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। বিনিয়োগের পরিমাণ অনুযায়ী ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে সিঙ্গাপুরের পর দুবাই হচ্ছে বাংলাদেশি ধনীদের পছন্দের গন্তব্য। তবে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিফোরএডিএস) সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, বিনিয়োগের এই পরিমাণ অন্তত দ্বিগুণ হতে পারে।

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ দুবাই ভূমি বিভাগের ২০২০ ও ২০২২ সালের রেকর্ড ও কিছু ইউটিলিটি কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনা করে একটি ডেটাসেট তৈরি করে। এই ডেটাসেটটি ২০২৪ সালের শুরুর দিকে অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের ‘দুবাই আনলকড’ শীর্ষক বৈশ্বিক তদন্তে ব্যবহার করা হয়। তবে, সেখানে বাংলাদেশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এই ডেটাবেস পর্যালোচনা করে যায়, ৪৬১ বাংলাদেশির নামে দুবাইয়ে ৯২৯টি সম্পত্তি নিবন্ধিত রয়েছে। এসব সম্পত্তির মধ্যে ২৫৯টি রাজনীতিবিদ, বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের নামে নিবন্ধিত।

এই ৪৬১ জনের নাম ও তাদের সম্পত্তির সংখ্যা ২০২০ ও ২০২২ সালের ডেটা থেকে নেয়া হয়েছে, যা সংগ্রহ করেছে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ। এসব সম্পত্তির মালিকরা এর মধ্যে কিছু সম্পত্তি বেচতে পারেন বা নতুন আরো সম্পত্তি কিনতে পারেন। ভূমি রেকর্ড ব্যবহার করে ৯২৯টি সম্পত্তির মধ্যে ২৭১টির মূল্য বিশ্লেষণ করেছে, যেগুলোর মূল্য সহজে পাওয়া যায়। এই ২৭১টি সম্পত্তির দাম অনুযায়ী মোট ৯২৯টি সম্পত্তির দাম প্রাক্কলন করে দেখা গেছে যে, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন সম্পত্তির মোট দাম ৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।

দুবাইয়ের ভূমি বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি সম্পত্তি কর ও সেবা চার্জ সম্পর্কিত নথি সংগ্রহ করা গেছে, এমন ১৯ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১৯ জন ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ৮২টি সম্পত্তির কর, সেবা চার্জ ও অন্যান্য নথি সংগ্রহ করা গেছে। সংগৃহীত তথ্য থেকে এসব সম্পত্তির দলিল নম্বর পাওয় যায় এবং দুবাইয়ের ভূমি বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে সেগুলো যাচাই করা হয়েছে। দুবাই আনলকড প্রজেক্টের জন্য ওসিসিআরপি যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, সেই একই পদ্ধতিতে ব্যবহার করে এসব সম্পত্তির মালিকানা যাচাই করা হয়েছে।

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেসে অ্যাক্সেস পাওয়ার পাঁচ মাস পর—গত বছরের ডিসেম্বরে—এই ১৯ জন ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে ৮২টি সম্পত্তি তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়েছে। একটি সম্পত্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

এই ১৯ জনের মধ্যে অন্যতম: সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, ঢাকা-১০ আসনের সাবেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য এইচবিএম ইকবাল, ঢাকা-১০ আসনের সাবেক বিএনপি সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালু, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জিসান মির্জা, ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফাত, ব্যবসায়ী সায়েম সোবহান আনভীর ও তার ভাই সাফওয়ান সোবহান তাসবীর, ওরিয়ন গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম, পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এমএ হাশেমের দুই ছেলে আজিজ আল কাইসার ও আজিজ আল মাসুদ। এ ছাড়া, তালিকায় আছেন শাহাব সাত্তার ও তাসবীরুল আহমেদ চৌধুরী, যারা বন্ধ হয়ে যাওয়া জিএমজি ও ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের মালিক বা প্রধান ছিলেন। নথি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শাহাব সাত্তার ও তাসবীরুল আহমেদ চৌধুরীর কাছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ৭৮৫ কোটি টাকা পাওনা।

তবে, দুবাইয়ে এসব সম্পত্তি কেনার টাকার উৎস কী, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নিভ। এমনকি বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করেই এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে, তেমন কোনো প্রমাণও হাতে নেই। বাংলাদেশের কঠোর মুদ্রা নীতি অনুযায়ী, দেশ থেকে মূলধন স্থানান্তর নিষিদ্ধ। তবে, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব বা বৈদেশিক আয় আছে, তারা বৈধভাবে বিশ্বের যেকোনো স্থানে সম্পত্তি কিনতে পারেন এবং অবশ্যই সেটা আয়কর নথিতে ঘোষণা করতে হবে।

এই ব্যক্তিরা দুবাইয়ে তাদের সম্পত্তির তথ্য নিজেদের আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন কিনা, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পাঁচ মাস ধরে তদন্তে দেখা যায়, এই ব্যাক্তিদের কেউ কেউ বর্তমানে বা আগে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। তাদের কেউ আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন, আবার কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। গত নভেম্বরে এমন অন্তত তিনজন আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন, যাদের সম্পত্তি রয়েছে দুবাইয়ে। অনেকের নামে শত শত কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ না করা ও অন্যান্য আর্থিক অনিয়মের মামলা রয়েছে। আবার অনেকের কোম্পানির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত চলমান।

দুবাই ভূমি বিভাগের সরকারি রেকর্ড এবং সম্পত্তির প্রতি বর্গফুটের গড় দামের ভিত্তিতে প্রাক্কলন করা হয়েছে যে, এই ১৯ জনের মালিকানাধীন ৮২টি সম্পত্তির মোট মূল্য প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। কিছু ক্ষেত্রে এসব সম্পত্তি পরিবারের সদস্য বা অন্যান্য একাধিক সুবিধাভোগীর নামে রয়েছে। কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের নাম এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে না, কারণ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে এখনো এমন কোনো প্রমাণ পায়নি যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এই সম্পত্তিগুলো বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় কেনা হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে এই ১৯ জনের মধ্যে ১৮ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। বাকি একজন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচজন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তাদের কেউ দাবি করেছেন, বিদেশে আয় থেকে বৈধভাবে এসব সম্পত্তি কিনেছেন। আবার কেউ তাদের বিরুদ্ধে চলমান তদন্তের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

মন্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে তার উত্তর দিয়েছেন- বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাফওয়ান সোবহান, ব্যাংকার নাফিজ সরাফাত, স্টার সিরামিকসের চেয়ারম্যান সৈয়দ একে আনোয়ারুজ্জামান, আরএকে সিরামিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ইকরামুজ্জামান, ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম, বাকিরা প্রশ্নের কোনো ধরনের উত্তর দেয়নি কিংবা মোবাইলে বা ইমেইলে তাদের পাওয়া যায়নি। সম্পত্তির তথ্য অনুযায়ী, তাদের পছন্দের জায়গাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুবাইয়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এলাকাগুলো। যেমন: বুর্জ খলিফার কাছাকাছি এলাকার সম্পত্তি, যেগুলো শহরের আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে চিহ্নিত মার্সা দুবাই, দুবাইয়ের অর্থনৈতিক জেলা বিজনেস বে, পারস্য উপসাগরের বিলাসবহুল কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ পাম জুমেইরা,

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেস অনুযায়ী, দুইজন বাংলাদেশি বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ভেতরেও ফ্ল্যাট কিনেছেন। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র সায়েম সোবহান আনভীরের নাম প্রকাশ করছেন, কারণ দুবাই ভূমি বিভাগ থেকে শুধুমাত্র তার নথি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। পাম জুমেইরায় সম্পত্তির মালিক ২০ বাংলাদেশির মধ্যে এমন ৮ জন আছেন, যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের মামলা রয়েছে। বুর্জ খলিফা এলাকায় বাংলাদেশি মালিকানাধীন অন্তত ৬১টি সম্পত্তি রয়েছে। যার মধ্যে ২১টির নিবন্ধন চারজন ব্যক্তির নামে, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, এসব সম্পত্তির মধ্যে অনেকগুলো গোল্ডেন ভিসা ব্যবহার করে লেয়ারিং পদ্ধতিতে কেনা হয়েছে। যেমন: বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের ফ্ল্যাটটি তার যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি ওয়ার্ল্ডএরা করপোরেশন এফজেডইর নামে কেনা হয়েছে। কোম্পানিটিতে তিনি পরিচালক হিসেবে আছেন। কোম্পানিটির নথিতে আনভীরকে স্লোভাকিয়ার নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্লোভাকিয়ার গোল্ডেন পাসপোর্টকে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল বলে মনে করা হয়। এর জন্য অন্তত ১০০ মিলিয়ন ইউরো বা প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে হয়।

সায়েম সোবহানের ভাই সাফওয়ান সোবহানের ঠিকানা দুবাইয়ের কর্নিশ ১ স্ট্রিটে এমিরেটস হিল থার্ড এলাকায়। তবে, দুবাই ভূমি বিভাগ থেকে এই বাড়িটির মালিকানার তথ্য যাচাই করা যায়নি। যুক্তরাজ্যের কোম্পানি রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশ নয়, সাইপ্রাসের নাগরিক। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে সাইপ্রাসের সংবাদপত্র এলিথিয়ার প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি সংগ্রহ করেছে, যেখানে তার নাগরিকত্ব ঘোষণা করা হয়।

আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, একটি কর্মসূচির অধীনে সাইপ্রাস ধনী বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেয়। এর জন্য প্রায় ২০ লাখ ইউরো বা প্রায় ২৫ লাখ ডলার সাইপ্রাসের রিয়েল এস্টেটে এবং আরো ২ লাখ ইউরো সাইপ্রাস সরকারের গবেষণা ও ভূমি উন্নয়ন তহবিলে বিনিয়োগ করতে হয়। ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিমও দুবাইয়ে সম্পত্তি কিনতে একই পথ অনুসরণ করেছেন বলে মনে হয়। তার নামে দুবাইয়ে যেসব সম্পত্তি নিবন্ধিত রয়েছে, তার কোনোটিই বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেনা হয়নি।

দুবাইয়ের একটি হোটেলের রেজিস্ট্রেশন নথিতে তাকে আলবেনিয়ার নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই হোটেলে তার মালিকানা রয়েছে। আলবেনিয়ার করপোরেট রেজিস্ট্রির রেকর্ডে তার মালিকানাধীন একটি কোম্পানি অ্যাগ্রি প্রোডাক্টস ইউরোপের উল্লেখ রয়েছে, যা ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিমের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দিয়েছে আলবেনিয়া।

বাহরাইনের করপোরেট রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, ওরিয়ন ফার্মা বাহরাইনের ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেডের। এই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে ছিলেন। তবে সেখানে তার ছেলেকে বাংলাদেশি হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ওবায়দুল করিমকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কোম্পানিটি ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়।

দুবাইয়ের কোম্পানি রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, ওবায়দুল করিমের মেয়ে জারিন করিম সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি জেশা জেনারেল ট্রেডিং এলএলসির মালিক, যেখানে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাকে ডোমিনিকান নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সূত্র ধরে ওবায়দুল করিম ও তার স্ত্রী আরজুদা করিমের ডোমিনিকান পাসপোর্টের একটি কপি হাতে পাওয়া গেছে। যেগুলো ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর ইস্যু করা হয়। ঢাকা বিমানবন্দর সূত্র নিশ্চিত করেছে, এই পাসপোর্টগুলো আসল।

২০২৪ সালে জারিন করিম ডোমিনিকার সম্মানসূচক কনসাল হিসেবে বাংলাদেশে নিয়োগ পান এবং তিনি এখনো এই পদে আছেন। বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, ডোমিনিকান রিপাবলিকে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এর জন্য দেশটির রিয়েল এস্টেট খাতে ২ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে হয় অথবা দেশটির অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ তহবিলে এই পরিমাণ অর্থ দিতে হয়।

দুবাইয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের অন্তত ৩৭টি সম্পত্তি রয়েছে, যার মোট মূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। দুবাইয়ে কোনো বাংলাদেশির নামে নিবন্ধিত সর্বোচ্চ সংখ্যক সম্পত্তি তার নামে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি সম্পত্তি তিনি কিনেছেন নিজেকে আমেরিকান সামোয়ার নাগরিক দেখিয়ে। আমেরিকান সামোয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঞ্চল, যা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের সাতটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, তার নামে থাকা প্রায় ৫০ কোটি টাকা দামের আরো ১৬টি সম্পত্তি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতবদল হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ২০২৪ সালে, নয়টি ২০২৩ সালে, একটি ২০২২ সালে এবং দুটি ২০২১ সালে বিক্রি হয়েছে।

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেস অনুযায়ী, এই নামে আরো অন্তত ২৪টিরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে। কিন্তু, রেকর্ডে পাসপোর্ট নম্বর ও জন্ম তারিখের মতো অন্য কোনো বিবরণ না থাকায় এটি নিশ্চিত নয় যে, সম্পত্তিগুলো তারই। তার ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির নামে পাম জুমেইরার গোল্ডেন মাইল ৪-এ দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট আছে, যার মূল্য আনুমানিক ১০ কোটি টাকা।

About Author Information

পঠিত

দুবাইয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের অঢেল সম্পদের সন্ধান

দুবাইয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের অঢেল সম্পদের সন্ধান

আপডেট : ১২:২৪:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশি ধনীদের কাছে দুবাই ভীষণ প্রিয়। অনেকে এটিকে সেকেন্ড হোম হিসেবে আপন করে নিয়েছেন। দুবাইয়ের দ্রুত সম্প্রসারিত আবাসন খাত বাংলাদেশিদের জন্য সম্পদ গচ্ছিত রাখার আকর্ষণীয় জায়গা। এর বড় কারণ হলো—সুউচ্চ ভবন ও পর্যটনের জন্য খ্যাত দুবাইয়ে নগদ অর্থ দিয়ে সম্পত্তি কেনা যায়। এমনকি শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোও নগদ অর্থে সম্পত্তি বিক্রি করে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বারবারই দুবাইকে হুন্ডি লেনদেনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। বিশাল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক ও বাংলাদেশিদের সেখানে অবস্থান করা এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া, দুবাইয়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার ডলার বা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি অর্থ দেশটির সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করলে ‘গোল্ডেন ভিসা’ পাওয়া যায়।

দুবাইয়ের ভূমি বিভাগের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রিয়েল এস্টেট খাতে ২০ লাখ আরব আমিরাত দিরহাম বা তার বেশি দামের সম্পত্তি ক্রয়ে বিনিয়োগকারীদের ১০ বছরের নবায়নযোগ্য রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদন করার সুযোগ দেয় এই সেবা (গোল্ডেন ভিসা)। স্বামী বা স্ত্রী, সন্তান ও পিতামাতাকেও এই ভিসায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। যদি সম্পত্তিটি বন্ধক থাকে, তাহলে ২০ লাখ দিরহাম পরিশোধের প্রমাণ হিসেবে ব্যাংকের একটি চিঠি জমা দিতে হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্যাক্স অবজারভেটরির ২০২১ সালের প্রাক্কলন অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন অফশোর সম্পত্তির দাম ২৬ কোটি ডলার বা প্রায় ৩ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। বিনিয়োগের পরিমাণ অনুযায়ী ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে সিঙ্গাপুরের পর দুবাই হচ্ছে বাংলাদেশি ধনীদের পছন্দের গন্তব্য। তবে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিফোরএডিএস) সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, বিনিয়োগের এই পরিমাণ অন্তত দ্বিগুণ হতে পারে।

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ দুবাই ভূমি বিভাগের ২০২০ ও ২০২২ সালের রেকর্ড ও কিছু ইউটিলিটি কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনা করে একটি ডেটাসেট তৈরি করে। এই ডেটাসেটটি ২০২৪ সালের শুরুর দিকে অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের ‘দুবাই আনলকড’ শীর্ষক বৈশ্বিক তদন্তে ব্যবহার করা হয়। তবে, সেখানে বাংলাদেশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এই ডেটাবেস পর্যালোচনা করে যায়, ৪৬১ বাংলাদেশির নামে দুবাইয়ে ৯২৯টি সম্পত্তি নিবন্ধিত রয়েছে। এসব সম্পত্তির মধ্যে ২৫৯টি রাজনীতিবিদ, বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের নামে নিবন্ধিত।

এই ৪৬১ জনের নাম ও তাদের সম্পত্তির সংখ্যা ২০২০ ও ২০২২ সালের ডেটা থেকে নেয়া হয়েছে, যা সংগ্রহ করেছে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ। এসব সম্পত্তির মালিকরা এর মধ্যে কিছু সম্পত্তি বেচতে পারেন বা নতুন আরো সম্পত্তি কিনতে পারেন। ভূমি রেকর্ড ব্যবহার করে ৯২৯টি সম্পত্তির মধ্যে ২৭১টির মূল্য বিশ্লেষণ করেছে, যেগুলোর মূল্য সহজে পাওয়া যায়। এই ২৭১টি সম্পত্তির দাম অনুযায়ী মোট ৯২৯টি সম্পত্তির দাম প্রাক্কলন করে দেখা গেছে যে, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন সম্পত্তির মোট দাম ৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।

দুবাইয়ের ভূমি বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি সম্পত্তি কর ও সেবা চার্জ সম্পর্কিত নথি সংগ্রহ করা গেছে, এমন ১৯ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১৯ জন ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ৮২টি সম্পত্তির কর, সেবা চার্জ ও অন্যান্য নথি সংগ্রহ করা গেছে। সংগৃহীত তথ্য থেকে এসব সম্পত্তির দলিল নম্বর পাওয় যায় এবং দুবাইয়ের ভূমি বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে সেগুলো যাচাই করা হয়েছে। দুবাই আনলকড প্রজেক্টের জন্য ওসিসিআরপি যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, সেই একই পদ্ধতিতে ব্যবহার করে এসব সম্পত্তির মালিকানা যাচাই করা হয়েছে।

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেসে অ্যাক্সেস পাওয়ার পাঁচ মাস পর—গত বছরের ডিসেম্বরে—এই ১৯ জন ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে ৮২টি সম্পত্তি তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়েছে। একটি সম্পত্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

এই ১৯ জনের মধ্যে অন্যতম: সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, ঢাকা-১০ আসনের সাবেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য এইচবিএম ইকবাল, ঢাকা-১০ আসনের সাবেক বিএনপি সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালু, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জিসান মির্জা, ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফাত, ব্যবসায়ী সায়েম সোবহান আনভীর ও তার ভাই সাফওয়ান সোবহান তাসবীর, ওরিয়ন গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম, পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এমএ হাশেমের দুই ছেলে আজিজ আল কাইসার ও আজিজ আল মাসুদ। এ ছাড়া, তালিকায় আছেন শাহাব সাত্তার ও তাসবীরুল আহমেদ চৌধুরী, যারা বন্ধ হয়ে যাওয়া জিএমজি ও ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের মালিক বা প্রধান ছিলেন। নথি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শাহাব সাত্তার ও তাসবীরুল আহমেদ চৌধুরীর কাছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ৭৮৫ কোটি টাকা পাওনা।

তবে, দুবাইয়ে এসব সম্পত্তি কেনার টাকার উৎস কী, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নিভ। এমনকি বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করেই এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে, তেমন কোনো প্রমাণও হাতে নেই। বাংলাদেশের কঠোর মুদ্রা নীতি অনুযায়ী, দেশ থেকে মূলধন স্থানান্তর নিষিদ্ধ। তবে, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব বা বৈদেশিক আয় আছে, তারা বৈধভাবে বিশ্বের যেকোনো স্থানে সম্পত্তি কিনতে পারেন এবং অবশ্যই সেটা আয়কর নথিতে ঘোষণা করতে হবে।

এই ব্যক্তিরা দুবাইয়ে তাদের সম্পত্তির তথ্য নিজেদের আয়কর নথিতে উল্লেখ করেছেন কিনা, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পাঁচ মাস ধরে তদন্তে দেখা যায়, এই ব্যাক্তিদের কেউ কেউ বর্তমানে বা আগে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। তাদের কেউ আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন, আবার কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। গত নভেম্বরে এমন অন্তত তিনজন আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন, যাদের সম্পত্তি রয়েছে দুবাইয়ে। অনেকের নামে শত শত কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ না করা ও অন্যান্য আর্থিক অনিয়মের মামলা রয়েছে। আবার অনেকের কোম্পানির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত চলমান।

দুবাই ভূমি বিভাগের সরকারি রেকর্ড এবং সম্পত্তির প্রতি বর্গফুটের গড় দামের ভিত্তিতে প্রাক্কলন করা হয়েছে যে, এই ১৯ জনের মালিকানাধীন ৮২টি সম্পত্তির মোট মূল্য প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। কিছু ক্ষেত্রে এসব সম্পত্তি পরিবারের সদস্য বা অন্যান্য একাধিক সুবিধাভোগীর নামে রয়েছে। কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের নাম এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে না, কারণ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে এখনো এমন কোনো প্রমাণ পায়নি যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এই সম্পত্তিগুলো বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় কেনা হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে এই ১৯ জনের মধ্যে ১৮ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। বাকি একজন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচজন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তাদের কেউ দাবি করেছেন, বিদেশে আয় থেকে বৈধভাবে এসব সম্পত্তি কিনেছেন। আবার কেউ তাদের বিরুদ্ধে চলমান তদন্তের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

মন্তব্য জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে তার উত্তর দিয়েছেন- বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাফওয়ান সোবহান, ব্যাংকার নাফিজ সরাফাত, স্টার সিরামিকসের চেয়ারম্যান সৈয়দ একে আনোয়ারুজ্জামান, আরএকে সিরামিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ইকরামুজ্জামান, ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম, বাকিরা প্রশ্নের কোনো ধরনের উত্তর দেয়নি কিংবা মোবাইলে বা ইমেইলে তাদের পাওয়া যায়নি। সম্পত্তির তথ্য অনুযায়ী, তাদের পছন্দের জায়গাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুবাইয়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এলাকাগুলো। যেমন: বুর্জ খলিফার কাছাকাছি এলাকার সম্পত্তি, যেগুলো শহরের আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে চিহ্নিত মার্সা দুবাই, দুবাইয়ের অর্থনৈতিক জেলা বিজনেস বে, পারস্য উপসাগরের বিলাসবহুল কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ পাম জুমেইরা,

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেস অনুযায়ী, দুইজন বাংলাদেশি বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ভেতরেও ফ্ল্যাট কিনেছেন। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র সায়েম সোবহান আনভীরের নাম প্রকাশ করছেন, কারণ দুবাই ভূমি বিভাগ থেকে শুধুমাত্র তার নথি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। পাম জুমেইরায় সম্পত্তির মালিক ২০ বাংলাদেশির মধ্যে এমন ৮ জন আছেন, যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের মামলা রয়েছে। বুর্জ খলিফা এলাকায় বাংলাদেশি মালিকানাধীন অন্তত ৬১টি সম্পত্তি রয়েছে। যার মধ্যে ২১টির নিবন্ধন চারজন ব্যক্তির নামে, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, এসব সম্পত্তির মধ্যে অনেকগুলো গোল্ডেন ভিসা ব্যবহার করে লেয়ারিং পদ্ধতিতে কেনা হয়েছে। যেমন: বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের ফ্ল্যাটটি তার যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি ওয়ার্ল্ডএরা করপোরেশন এফজেডইর নামে কেনা হয়েছে। কোম্পানিটিতে তিনি পরিচালক হিসেবে আছেন। কোম্পানিটির নথিতে আনভীরকে স্লোভাকিয়ার নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্লোভাকিয়ার গোল্ডেন পাসপোর্টকে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল বলে মনে করা হয়। এর জন্য অন্তত ১০০ মিলিয়ন ইউরো বা প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে হয়।

সায়েম সোবহানের ভাই সাফওয়ান সোবহানের ঠিকানা দুবাইয়ের কর্নিশ ১ স্ট্রিটে এমিরেটস হিল থার্ড এলাকায়। তবে, দুবাই ভূমি বিভাগ থেকে এই বাড়িটির মালিকানার তথ্য যাচাই করা যায়নি। যুক্তরাজ্যের কোম্পানি রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশ নয়, সাইপ্রাসের নাগরিক। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে সাইপ্রাসের সংবাদপত্র এলিথিয়ার প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি সংগ্রহ করেছে, যেখানে তার নাগরিকত্ব ঘোষণা করা হয়।

আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, একটি কর্মসূচির অধীনে সাইপ্রাস ধনী বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেয়। এর জন্য প্রায় ২০ লাখ ইউরো বা প্রায় ২৫ লাখ ডলার সাইপ্রাসের রিয়েল এস্টেটে এবং আরো ২ লাখ ইউরো সাইপ্রাস সরকারের গবেষণা ও ভূমি উন্নয়ন তহবিলে বিনিয়োগ করতে হয়। ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিমও দুবাইয়ে সম্পত্তি কিনতে একই পথ অনুসরণ করেছেন বলে মনে হয়। তার নামে দুবাইয়ে যেসব সম্পত্তি নিবন্ধিত রয়েছে, তার কোনোটিই বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেনা হয়নি।

দুবাইয়ের একটি হোটেলের রেজিস্ট্রেশন নথিতে তাকে আলবেনিয়ার নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই হোটেলে তার মালিকানা রয়েছে। আলবেনিয়ার করপোরেট রেজিস্ট্রির রেকর্ডে তার মালিকানাধীন একটি কোম্পানি অ্যাগ্রি প্রোডাক্টস ইউরোপের উল্লেখ রয়েছে, যা ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিমের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দিয়েছে আলবেনিয়া।

বাহরাইনের করপোরেট রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, ওরিয়ন ফার্মা বাহরাইনের ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেডের। এই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে ছিলেন। তবে সেখানে তার ছেলেকে বাংলাদেশি হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ওবায়দুল করিমকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কোম্পানিটি ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়।

দুবাইয়ের কোম্পানি রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, ওবায়দুল করিমের মেয়ে জারিন করিম সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি জেশা জেনারেল ট্রেডিং এলএলসির মালিক, যেখানে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাকে ডোমিনিকান নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সূত্র ধরে ওবায়দুল করিম ও তার স্ত্রী আরজুদা করিমের ডোমিনিকান পাসপোর্টের একটি কপি হাতে পাওয়া গেছে। যেগুলো ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর ইস্যু করা হয়। ঢাকা বিমানবন্দর সূত্র নিশ্চিত করেছে, এই পাসপোর্টগুলো আসল।

২০২৪ সালে জারিন করিম ডোমিনিকার সম্মানসূচক কনসাল হিসেবে বাংলাদেশে নিয়োগ পান এবং তিনি এখনো এই পদে আছেন। বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, ডোমিনিকান রিপাবলিকে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। এর জন্য দেশটির রিয়েল এস্টেট খাতে ২ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে হয় অথবা দেশটির অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ তহবিলে এই পরিমাণ অর্থ দিতে হয়।

দুবাইয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের অন্তত ৩৭টি সম্পত্তি রয়েছে, যার মোট মূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। দুবাইয়ে কোনো বাংলাদেশির নামে নিবন্ধিত সর্বোচ্চ সংখ্যক সম্পত্তি তার নামে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি সম্পত্তি তিনি কিনেছেন নিজেকে আমেরিকান সামোয়ার নাগরিক দেখিয়ে। আমেরিকান সামোয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঞ্চল, যা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের সাতটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, তার নামে থাকা প্রায় ৫০ কোটি টাকা দামের আরো ১৬টি সম্পত্তি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতবদল হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ২০২৪ সালে, নয়টি ২০২৩ সালে, একটি ২০২২ সালে এবং দুটি ২০২১ সালে বিক্রি হয়েছে।

সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের ডেটাবেস অনুযায়ী, এই নামে আরো অন্তত ২৪টিরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে। কিন্তু, রেকর্ডে পাসপোর্ট নম্বর ও জন্ম তারিখের মতো অন্য কোনো বিবরণ না থাকায় এটি নিশ্চিত নয় যে, সম্পত্তিগুলো তারই। তার ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনির নামে পাম জুমেইরার গোল্ডেন মাইল ৪-এ দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট আছে, যার মূল্য আনুমানিক ১০ কোটি টাকা।