সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪
spot_imgspot_img

Top 5 This Week

spot_img

Related Posts

গফরগাঁওকে ‘ত্রাসের রাজত্ব’ বানিয়েছিলেন আওয়ামী গডফাদার ফাহমী গোলন্দাজ

তিন স্তরে উঁচু সীমানাপ্রাচীরের দুটি প্রাচীর ভেঙে পড়ে আছে। বাড়ির ভেতরে ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুনও দেওয়া হয়েছে কোথাও কোথাও। তালাবদ্ধ দোতলা ভবন। ভাঙা বাড়িটি দেখতে এসেছেন আশপাশের গ্রামের নারী, পুরুষ ও শিশুরা।

সালটিয়া গ্রামের আবদুর রাজ্জাক নামের এক বৃদ্ধ বললেন, ‘প্রত্যেক দিন আমি এই বাড়ির সামনে দিয়া গেছি। উঁচা বাউন্ডারি (প্রাচীর) থাকায় কোনো দিন ভিতরের কিছু দেখা নাই। হুনছি, বাড়িটার ভিতরে মানুষরে ধইরা নিয়ে নির্যাতন করা হইত।’

ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার সালটিয়া ইউনিয়নের বাগুয়া এলাকায় অবস্থিত এই বাড়ি সাবেক সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ ওরফে বাবেলের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে গেলে গত ৫ আগস্ট তাঁর বাড়িতে হামলার চেষ্টা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর ভোরে একদল লোক বাড়ির দুটি ফটক গুঁড়িয়ে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ‘টর্চার সেল’ আখ্যা দিয়ে তারা বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এ সময় একটি টিনশেডের ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় দুটি গাড়ি।

৯ সেপ্টেম্বর বাড়িটি ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ আটকে যায় পেছন দিকে পুকুরপাড়ের একটি টিনের চালার নিচে তিনটি লোহার খাঁচায়। খাঁচাগুলো শূন্য। খাঁচায় কী রাখা হতো, এমন আলোচনা উঠতেই বাড়ি দেখতে আসা ব্যক্তিদের একজন নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘শুনেছি একটি খাঁচায় কুকুর রাখা হতো। কেউ এমপি সাইবের সাথে বেয়াদবি করলে তাকে কুকুরের খাঁচায় ছেড়ে দিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো।’

২০১৪ সালে প্রথমবার ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ফাহমী গোলন্দাজের বেপরোয়া শাসন শুরু হয় বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা।

৯ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গফরগাঁওয়ে অবস্থান করে সাধারণ মানুষ, বিএনপির নেতা-কর্মী, সাংবাদিক ও সুধীজনদের সঙ্গে দৈনিক নতুন বাংলাদেশ -এর কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, উপজেলার ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে কমিশন আদায় ও অবৈধ বালুর ব্যবসা থেকে বিপুল টাকা কামিয়েছেন ফাহমী। একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এলাকাছাড়া করেছেন বিএনপির নেতা–কর্মীদের। তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করে আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীরাও এলাকায় থাকতে পারেননি। কথা না শুনলে বাড়িতে তুলে এনে নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। এখন তিনি আত্মগোপনে যাওয়ায় মানুষ কিছুটা স্বস্তির কথা জানালেও পুরোপুরি ভীতি কাটছে না।

ঠিকাদারিতে আধিপত্য বিস্তার

২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে শীতের রাতে গফরগাঁও উপজেলা ঠিকাদার সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামানকে বাড়িতে ডেকে আনেন ফাহমী। ওই সময় বাড়িতে থাকা তরুণদের সামনে আসাদুজ্জামানের উদ্দেশে ফাহমী বলেন, ‘আপনি কি নিজে নিজে পুকুরের পানিতে নামবেন, নাকি আমার ছেলেরা জোর করে নামাবে?’ এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার দৈনিক নতুন বাংলাদেশ কে বলেন, ওই রাতে ফাহমী গোলন্দাজ আসাদুজ্জামানকে সাফ জানিয়ে দেন, গফরগাঁওয়ের সব ঠিকাদারি কাজ শুরুর আগে মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশ কমিশন তাঁকে দিতে হবে।

১০ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আসাদুজ্জামান কোনো মন্তব্য করতে চাননি। শুধু বলেন, ‘আমার ছেলে এখনো গফরগাঁওয়ে থাকে। আমাকে বিপদে ফেলবেন না।’

বালুর অবৈধ ব্যবসা

ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ঘেঁষে গফরগাঁও উপজেলার অবস্থান। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিটিএ) প্রকল্পের অধীনে নদে খনন শুরু হয়। প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা বলেন, কাজ শুরুর সময়ই ফাহমী গোলন্দাজ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিনা পয়সায় বালু নেওয়া। পরে কাজ শুরু হলে (এখনো চলমান) উপজেলার ধলা থেকে কাপাসিয়ার টোক পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার অংশের অবৈধ বালু–বাণিজ্য নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন ফাহমী।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বালু তুলে নদের পাশের জমিতে রাখা হতো, যা পরে নিলামে বিক্রি করা হতো। নিলামে কেনা বালু ব্যবসায়ীরা নিয়ে যাওয়ার পর ফাহমীর লোকেরা নদ খনন করে এবং নদের পাশের কৃষকদের জমি থেকে আবারও বালু তুলতেন। ৪০ কিলোমিটার অংশকে মোট সাতটি ভাগে ভাগ করে বছরে একবার মোটা অঙ্কের টাকা বালু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিতেন। এ ছাড়া বালু উত্তোলনের সময় প্রতিদিন প্রতিটি ট্রাক থেকে নেওয়া হতো ৬০০ টাকা আর প্রতিটি লরিতে ২০০ টাকা। এভাবে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি ট্রাক ও লরি থেকে কয়েক লাখ টাকা আসত। পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজমুন আহমেদ এই অবৈধ বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনিও এখন এলাকায় নেই।

অবৈধভাবে বালু তুলে ফাহমীর লোকেরা অসংখ্য কৃষকের ফসলি জমি নষ্ট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সালটিয়া গ্রামে নদের পাড়ে স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল মান্নানের কৃষিজমি রয়েছে। বালু তুলতে বাধা দেওয়ায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারির ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবদুল মান্নান বলেন, ‘গ্রামের কিছু কৃষকের পক্ষ হয়ে ওই দিন এমপির (ফাহমী) লোকদের কৃষিজমির বালু তুলতে বাধা দিয়েছিলাম। খবর পেয়ে এমপি নিজেই লোকজন নিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যান। এরপর একটি ঘরে বন্দী করে রেখে তাঁর লোকদের পাঠিয়ে আমার ও কৃষকদের জমির মাটি কেটে নদের পানির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। আমার পেশা সাংবাদিকতা না হলে ওই দিন আমাকে হয়তো মেরে ফেলতেন।’

ভয়ে বাড়িতে থাকতেন না

২০১৪ সালের ১৩ জুন সন্ধ্যায় যুবদল কর্মী শাকিল আহমেদ অগ্নিবীণা ট্রেনে এসে গফরগাঁও স্টেশনে নামেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ছিনতাইকারী অভিযোগ তুলে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ তাঁকে বাঁচাতে আটক করে নিয়ে যেতে চাইলে ছিনিয়ে নিয়ে আবারও মারধর করা হয়। এতে শাকিল মারা যান। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা এই হামলা চালান বলে তখন অভিযোগ করেছিলেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা। শাকিল হত্যায় পুলিশ মামলা না নিলে পরে আদালতে একটি মামলা হয়।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, ফাহমী গোলন্দাজ প্রথম সংসদ সদস্য হওয়ার পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে পেলেই ছিনতাইকারী সাজিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এমন নির্দেশনার কারণে শাকিলকে হত্যা হয়। এ কারণে ১০ বছর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা গফরগাঁওয়ে থাকতে পারেননি। গ্রামের সাধারণ কর্মীরাও দলের কর্মসূচিতে যেতে চাইলে নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ বিএনপির।

গফরগাঁও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক ফজুলল হক দৈনিক নতুন বাংলাদেশ কে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তথা ফাহমী গোলন্দাজের ভয়ে আমরা গফরগাঁওয়ে থাকতাম না। তবু গত ২৮ অক্টোবরের পর ফাহমীর লোকেরা তাঁর খালি বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। একই দিন পৌর বিএনপির ৫ জন যুগ্ম আহ্বায়কের বাড়িতেও ভাঙচুর করে।’

আক্রোশের শিকার অনেকে

ভিন্নমত পোষণ করলেই নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও ফাহমী গোলন্দাজের আক্রোশের শিকার হতেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গফরগাঁও পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র ইকবাল হোসেন (সুমন) ছিলেন ফাহমীর অনুসারী। বিপত্তি বাধে ২০২২ সালের এপ্রিলে। ওই মাসে ইকবালের জন্মদিনে তাঁর এক প্রবাসী বন্ধু শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘আমার বন্ধু গফরগাঁও পৌরসভার মেয়রকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা, আগামীতে তাঁকে গফরগাঁওয়ের এমপি হিসাবে দেখতে চাই।’

এর এক মাস পর মেয়রের সমর্থকদের ওপর সংসদ সদস্যের সমর্থকেরা হামলা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকেই মেয়র ইকবাল হোসেন ও তাঁর সমর্থকেরা গফরগাঁও ছেড়ে যান। পরে আর ফিরতে পারেননি। সম্প্রতি সরকার পৌরসভার মেয়রদের বরখাস্ত করার দিন (১৯ আগস্ট) ইকবাল গফরগাঁও পৌরসভায় গিয়েছিলেন। সেদিন কিছু লোক তাঁকে মারধর করে পুলিশে দেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Popular Articles