শহীদুল জাহীদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নেতৃত্ব দৃশ্যত আন্তরিকভাবেই ব্যাংকিং খাতে সংস্কার করতে চায়। কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের বেশ কিছু অতিকথন জনমনে আশার আলো সঞ্চারের বিপরীতে হতাশা ও অনাস্থার জন্ম দিয়েছে।
প্রথমেই বলা হলো, আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক আমানত বিমার পরিমাণ এক লাখ থেকে দ্বিগুণ করে দুই লাখ করল। ছোট আমানতকারীরা আশ্বস্ত হলো।
দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের ব্যাংকিং কার্যক্রম বলতে গেলে অনেক দিন ধরে বন্ধই আছে। তাদের চেক ক্লিয়ারিং হচ্ছে না, বন্ধ রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যে সহায়তা কার্যক্রম। রেমিট্যান্স প্রবাহ শূন্যের কোঠায়।
নতুন বিনিয়োগ বন্ধ। ঋণ আদায় নেই বললেই চলে। কারণ, যারা ঋণ নিয়েছে, তারা হয় রাঘববোয়াল এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে অথবা বেনামে নেওয়া ঋণ হিসাবের খাতা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। বন্ধ রয়েছে অনলাইন লেনদেন। অনাস্থায় নতুন কোনো আমানত আসছে না বলেই চলে।
এখন এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা চেক, ডিমান্ড ড্রাফট ইত্যাদি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে। কোনো কোনো শাখায় ব্যাংক কর্মচারীদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছে, ভাঙচুর হচ্ছে, টাকা ফেরত না পেয়ে কষ্ট ও ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যাচ্ছে।
আমানতকারীদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা হুমকির মুখে। তারা তাদের খরচ মেটাতে ও ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলল, তারল্যসংকটে থাকা এরূপ ব্যাংকে আপৎকালীন তারল্য সহায়তা দেবে। তারা সরাসরি টাকা ধার্য দেবে না।
তাতে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে এবং মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবনে কষ্ট তৈরি করবে। বরং বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের পক্ষে গ্যারান্টিপত্র দেবে, যে গ্যারান্টিপত্র দেখিয়ে তারল্যে উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংক থেকে ওই সব ব্যাংক নগদ তারল্য সহায়তা পাবে।
আপৎকালীন এ তারল্য সহায়তা স্বল্পমেয়াদি হবে এবং এর বিপরীতে সুদ বা মুনাফা দিতে হবে। জনগণ সরল বিশ্বাসে আস্থা রাখলেও এরূপ বন্দোবস্ত এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বেশ কিছু পদ্ধতিগত জটিলতা বাংলাদেশ ব্যাংক ভেবে দেখেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই জানে, ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংক তথা সুদি ব্যাংক থেকে ধারকর্জ করতে পারে না। এটি তাদের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখন সমস্যাগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংক অন্য কোনো ইসলামী ব্যাংক থেকে কর্জ করতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা, নিকট অতীতের সবচেয়ে সফল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি নিজেই এখন একটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক।
অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকের অবস্থাও সঙিন। প্রয়োজন ছিল ইসলামি অর্থবাজার তথা ইসলামি মানি মার্কেটের ব্যবস্থা প্রচলন করা, যা আজ অবধি কোনো সরকারই আমলে নেয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নেতৃত্বের উচিত হবে ইসলামি মানি মার্কেট প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও উদ্যোগ নেওয়া। গ্যারান্টিপত্র ইস্যু করে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের তারল্যসংকটের সমাধানের চিন্তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে।
প্রথম আলো আয়োজিত সাম্প্রতিক গোলটেবিল বৈঠকে গভর্নরের আহ্বান উদ্বৃত্ত তারল্য থাকা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা কৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছেন। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ইতিমধ্যে সমস্যায় থাকা ব্যাংকে তারল্য সহায়তা ঋণ দিলে তা খেলাপি হতে পারে।
সেই খেলাপি ঋণ উদ্ধারে নিয়ন্ত্রক ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়া তাদের জন্য বিব্রতকর। অন্যদিকে বিদেশি অডিট সংস্থা যখন দেখবে, এসব সচ্ছল ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক তথা মন্দ গ্রাহককে ঋণ দিয়েছে, তখন ওই সব সচ্ছল প্রতিষ্ঠানেরও আন্তর্জাতিক রেটিং খারাপ হতে পারে।
সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের কথায় তারল্যসংকটে থাকা ব্যাংকের আমানতকারীরা আস্থা রাখতে পারছে না।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে কথার চেয়ে কাজে বেশি মনোযোগ দেওয়া, ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কষ্ট লাঘবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যর্থ হওয়া যাবে না।
- শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক।