ব্যাংকঋণের সুদহার বেশি, সে কারণে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। ইতিমধ্যে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ডিসেম্বরের পর সুদহার কমানোর দাবি তুলেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ব্যাংকঋণের সুদ কমলেই কি বিনিয়োগ বাড়বে? একসময় দেশে সুদহার নয়-ছয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। তখনই-বা কতটা বিনিয়োগ হয়েছে?
বিনিয়োগ বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজন অর্থায়ন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ব্যাংকই এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের মূল ভরসা। পুঁজিবাজার আছে, কিন্তু তা এখন পর্যন্ত বিনিয়োগের মূল উৎস হতে পারেনি। অর্থায়নের অন্যান্য উৎসও সে রকম শক্তিশালী কিছু নয়। সে জন্য বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের সুদ নিয়ে এত উচ্চকণ্ঠ।
ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়লে ব্যবসায় ব্যয় বেড়ে যায়। এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার বাড়তি থাকায় বিনিয়োগে প্রভাব পড়েছে, তা সত্য। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, বিনিয়োগ শুধু ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল নয়; অন্য আরও অনেক কিছুর সঙ্গে তার যোগ আছে।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ঋণের সুদহার বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক; এই নীতি নয়-ছয় হিসেবে পরিচিত। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়াতে শুরু করে। ফলে নয়-ছয় নীতি আর বাস্তবসম্মত থাকেনি। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক নয়-ছয় নীতি থেকে সরে আসে।
২০২৩ সালের জুলাই মাসের শুরুতে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাড়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। সব ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহারও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের জুলাই মাসে ব্যাংকঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাই মাসে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনেক দিন ধরেই ২৩ থেকে ২৪ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। নয়-ছয় নীতি চালুর পরও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়েনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির সাপেক্ষে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত ছিল ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ছিল ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশ; ২০২১–২২ অর্থ বছরে ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ২০২১–২২ অর্থ বছরের পর টানা দুই অর্থ বছরে বিনিয়োগ কমেছে। এই সময় বাংলাদেশ করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে শুরু হয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। বেসরকারি বিনিয়োগে যে এসব ঘটনার প্রভাব ছিল, তা বলাই বাহুল্য।
২০২০ সালে সারা বিশ্বে করোনা মহামারি শুরু হয়। সে বছরেই নয়-ছয় নীতি প্রণয়ন করা হয়। সে বছর জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ হয় ২৩.৭০ শতাংশ।
দেখা যাচ্ছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে মাত্র একবার বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৫ শতাংশে উঠেছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ছিল ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা ছিল ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা নেমে আসে ২৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ২৫ শতাংশের ঘরে ওঠার পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে নেমে আসে।